ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

লামার পাহাড়ে ঝুঁকিতে ৩ হাজার পরিবার

মাইকিং করেই দায়িত্ব শেষ প্রশাসনের: স্থায়ী পুনর্বাসনের উদ্যোগে নেই

লামা প্রতিনিধি ::   মুষলধারে বৃষ্টি নামলেই পার্বত্য লামা উপজেলার পাহাড়ি জনপদগুলোতে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। এখানকার পাহাড়ের চুড়া ও পাদদেশে এখনো মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে প্রায় ৩ হাজার পরিবার বসবাস করছে। টানা বর্ষণ শুরু হলে এ সকল পরিবারগুলোকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসন মাইকিং করেই দায়িত্ব শেষ করছেন।

সূত্র জানায়, লামা উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন এবং ১টি পৌরসভায় শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ পাহাড়ের চূড়া, পাদদেশ ও কোলঘেঁষে বসবাস করে আসছে যুগ যুগ ধরে। এ সকল বসবাসকারীদের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। বর্ষা মৌসুমে মুষলধারে বৃষ্টি নামলেই পাহাড় ধস আতংক ছড়িয়ে পড়ে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে। প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে উঠা পাহাড়গুলো কেটে জনবসতি স্থাপন, জুমচাষ, বৃক্ষনিধন এবং ব্রিকফিল্ডগুলোতে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে মাটি আহরণের ফলে বর্ষা মৌসুমে ব্যপক হারে পাহাড় ধস দেখা দেয়। পাহাড় ধসে প্রতিবছর ব্যপাক জানমালের ক্ষতি সাধিত হয়।

বসতি স্থাপনের বিকল্প কোন ব্যবস্থা না থাকায় এখনও পাহাড়ে রয়ে গেছে হাজার হাজার পরিবার। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, একের পর এক পাহাড় ধসে প্রাণহানির মত মানবিক বিপর্যয় ঘটলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি পরিকল্পিত বসবাস কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে স্থায়ী পুনর্বাসনের কোন উদ্যোগ। মাঝে মধ্যে পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারীদের উপজেলা প্রশাসন, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করে দায়িত্ব শেষ করছেন।

জেলার সবচেয়ে বেশী ঝুঁকিতে বসবাসকারী লামা উপজেলা হলেও পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে বসবাসরত পরিবারগুলোর কোনো নির্দিষ্ট তালিকা নেই প্রশাসনের কাছে। এছাড়াও দাতা সংস্থা এবং এনজিও গুলো প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা তথাকথিত উন্নয়নের নামে ব্যয় দেখিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বর্ষাকালে ভয়াবহ পাহাড় ধস ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় দুর্যোগ মুক্ত বিষয়ে মানবিক সহায়তা হিসেবে কোনো ধরনেরই আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপনের কর্মসূচি নেই এসব সংস্থার।

এদিকে, একের পর এক পাহাড় ধস ট্রাজেডিতে বাড়ছে লাশের মিছিল। ২০০৯ সালে আজিজনগর ও গজালিয়ায় এক পরিবারের ৬ জনসহ ১১ জন, ১৯৯৬ সালে পৌর এলাকার রাজবাড়িতে একই পরিবারের ৭ জন, ২০১২ সালের ২৭ জুন রাতে ফাইতং ইউনিয়নে ২৫ জন, রুপসীপাড়া ইউনিয়নে ২জন ও সদর ইউনিয়নে ২ জন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই লামা সদর ইউনিয়নে ৬জন এবং সর্বশেষ গত ৩ জুলাই পাহাড় ধ্বসে উপজেলার সরই ইউনিয়নের কালাইয়াপাড়ায় শিশু মহিলাসহ এক পরিবারের ৩জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে।

খোজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার আজিজনগর, ফাইতং, সরই, রুপসীপাড়া, সদর, গজালিয়া ও ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা এবং পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় কেটে অপরিকল্পিতবাবে ঘরবাড়ি তৈরি করে বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করে আসছে প্রায় তিন হাজার পরিবার। তাদের বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ।

স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করা না হলে, পাহাড় ছাড়তে নারাজ এসব ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারী পরিবারগুলো। লামা পৌরসভার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন, জামাল উদ্দিন জানান, আমরা গরীব মানুষ, এখানে সমতলের জমির দাম আকাশ ছোঁয়া। এত দামে আমাদের পক্ষে জমি কেনা সম্ভব নয়। পাহাড়ের জমি সমতল ভুমির চেয়ে অনেক সস্তা। তাই বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় মৃত্যু ঝুঁকি জেনেও পাহাড়ে বসবাস করছি।

লামা সদর ইউপি চেয়ারম্যান মিন্টু কুমার সেন চকরিয়া নিউজকে বলেন, অভাবি মানুষের পক্ষে সমতলে বসতি গড়ার সামর্থ না থাকায় পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসতি গড়ছে। লামা পৌরসভার মেয়র মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, পৌরসভা এলাকায় যারা পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন তাদেরকে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য বার বার মাইকিং এর মাধ্যমে তাগাদা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া দুর্যোগকালীন আশ্রয় কেন্দ্র খোলার পাশাপাশি আশ্রয় গ্রহিতাদের জন্য প্রয়োজনীয় খাবারসহ সকল ধরনের ব্যবস্থা করা হলেও অনেকে বাড়ি–ঘর ছেড়ে আসতে চায় না ।

এ বিষয়ে লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূর–এ–জান্নাত রুমি চকরিয়া নিউজকে জানান, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদেরকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং এর মাধ্যমে বারবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃপক্ষকেও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদেরকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য তাগিদ দিতে বলা হয়েছে। এর পরও সরে না গেলে প্রশাসন কঠোরতা অবলম্বন করবে।

স্থানীয় সচেতন মহল মনে করছেন, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের পাহাড়ে অতিঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারী পরিবার সমুহে যে কোন সময় বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তারা শুধু মৃত্যু ঝুঁকিতে বসবাস করছে তা নয়, জীবন যাত্রায় পানি, সামাজিক পরিবেশ, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ সুবিধাসহ নাগরিক অনেক সুযোগ সুবিধা পরিপূর্ণভাবে ভোগ করা থেকে এরা বঞ্চিত হচ্ছে। এসকল পরিবার সমুহের নিরাপদ বসবাস নিশ্চিত করতে পুনর্বাসনের বিকল্প নেই।

 

পাঠকের মতামত: